প্রথম সন্তানের জন্মের পর আমার জীবনটা যেন একেবারে পাল্টে গেল।
চারপাশে সবাই বলছিল—“মা হওয়া সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।”
হয়তো ঠিকই বলছিল, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন প্রতিদিন সকালে আমার বুকের ভেতর হঠাৎ করে হাহাকার তৈরি হয়, কেন আমি কিছুতেই হাসতে পারি না, কেন অকারণে কান্না আসে।
বাচ্চাটা একটানা কান্না করলেই আমি যেন ভেঙে পড়তাম। মনে হতো, আমি কি এতটাই অযোগ্য মা?
পরবর্তীতে জানলাম—এটাই হলো মাতৃত্বকালীন বিষণ্ণতা বা Postpartum Depression।
শুধু আমি না, প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে অন্তত ২-৩ জন এর মুখোমুখি হন।
তবে সেই অন্ধকার থেকে আমি ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছি। কিছু জিনিস প্রতিদিন করার মধ্য দিয়ে আমি আবারও নিজেকে ফিরে পেয়েছি।
আজ আমি সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে চাই—মাতৃত্বকালীন বিষণ্ণতা এড়াতে মাকে যেসব কাজগুলো করতে হবে।
১. নিজের অনুভূতি গুলোকে অস্বীকার না করে মেনে নেওয়া
সবার প্রথমে আমি যা শিখেছি, তা হলো—নিজের আবেগকে না চেপে রাখা।
প্রথম দিকে নিজের কান্নাকে আমি দুর্বলতা ভাবতাম। কিন্তু একদিন রাত ৩টায়, বাচ্চা ঘুমাতে না পেরে কাঁদছিল, আমি এক কোণে বসে চুপচাপ কাঁদছিলাম। তখন আমার মা এসে পাশে বসে বলেছিলেন,
“এই কান্নাগুলো অস্বাভাবিক না। সব মা কাঁদে। আমিও কেঁদেছি।”
সেই রাতে আমি বুঝলাম—কষ্টের কথা বলা মানেই আপনি দুর্বল নন, আপনি একজন মানুষ।
কি করবেন:
-
অনুভূতি গুলোকে জার্নালে লিখে ফেলুন।
-
প্রিয় কারো সঙ্গে কথা বলুন—বন্ধু, বোন, মা বা স্বামী।
-
মনে রাখবেন, নিজেকে বোঝানো মানেই ভালো থাকার শুরু।
২. পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম নিশ্চিত করা
ঘুমের ঘাটতিই বিষণ্ণতার অন্যতম কারণ।
আমার তখন মনে হতো, আমি যদি একটানা ৪ ঘণ্টাও ঘুমাতে পারতাম, তাহলে যেন পৃথিবীর সেরা বিলাসিতা পেতাম।
তাই আমি ঘুমের জন্য একটা কৌশল নিলাম—“যখন বাচ্চা ঘুমায়, আমিও ঘুমাবো।”
কাজ পরে করলেও চলে, কিন্তু ঘুম না হলে আমি নিজেই ভেঙে পড়ি।
কি করবেন:
-
প্রতিদিন অন্তত ৬-৭ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
-
ঘুমের পরিবেশ আরামদায়ক করুন (অন্ধকার, নীরবতা)।
-
রাতে কাউকে পালাক্রমে বাচ্চা দেখার অনুরোধ করুন।
৩. শারীরিক ফিটনেসে নজর দিন
প্রসবের পর একেবারেই শক্তি পাই না, হাঁটলেও মনে হতো, বুক ধড়ফড় করছে।
কিন্তু যখন ধীরে ধীরে হালকা ব্যায়াম, ১৫ মিনিট হাঁটা শুরু করলাম, তখন দেখলাম—মেজাজ ভালো থাকে, মন ফুরফুরে হয়।
কি করবেন:
-
প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট হাঁটুন।
-
ইউটিউবে postpartum yoga বা হালকা stretching খুঁজে নিতে পারেন।
-
ডাক্তার অনুমতি দিলে হালকা ব্যায়াম শুরু করুন।
৪. পুষ্টিকর খাবার খান, নিজেকে না ভুলে যান
সবার আগে আমি বাচ্চার খাওয়ার কথা ভাবতাম, এরপর স্বামীর, এরপর বাড়ির কাজ। কিন্তু একদিন বিকেলে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম রান্নাঘরে।
তখন বুঝলাম—নিজেকে ভুলে থাকলে কারো উপকার করা যায় না।
কি করবেন:
-
পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
-
ডিম, মাছ, দুধ, ফলমূল—রোজকার খাদ্যতালিকায় রাখুন।
-
না খেয়ে থাকার অভ্যাস ত্যাগ করুন।
৫. একা থাকবেন না—বন্ধু তৈরি করুন
একদিন খুব ভেঙে পড়েছিলাম। হঠাৎ ফেসবুকে এক মা-বাচ্চার গ্রুপে যোগ দিলাম। সেখানে গল্প করে, প্রশ্ন করে বুঝলাম—আমি একা নই।
সেই অনলাইনে অচেনা কিছু মা-ই আমার মানসিক চিকিৎসক হয়ে উঠলেন।
কি করবেন:
-
মায়েদের কোনো কমিউনিটি গ্রুপে যুক্ত হন (Facebook, WhatsApp)।
-
আপনার পাড়া বা পরিবারের অন্য মায়েদের সঙ্গে আড্ডা দিন।
-
দোষারোপ নয়, গল্প করে হালকা হোন।
৬. সময় বের করুন শুধু নিজের জন্য
আমার একদিন মনে হয়েছিল, আমি তো আর আমি নেই—আমি শুধু “মা” হয়ে গেছি।
তখন সিদ্ধান্ত নিই—প্রতি সপ্তাহে একদিন অন্তত ১ ঘণ্টা শুধুই আমার জন্য রাখবো।
একদিন বই পড়া, একদিন পুরনো গান শোনা, আবার একদিন শুধু চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকা—এই ছোট ছোট জিনিসগুলো আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
কি করবেন:
-
নিজের পছন্দের কিছু করুন (হস্তশিল্প, মুভি, গান, রান্না)।
-
একা সময় কাটান, guilt-free হয়ে।
-
স্বামী বা পরিবারের কাউকে বলুন: “এই এক ঘণ্টা শুধু আমার।”
৭. প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য নিন
বিষণ্ণতা কখনো কখনো নিজের চেষ্টা ছাড়াও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
আমি একপর্যায়ে এতটাই মানসিক চাপ অনুভব করছিলাম যে, কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
প্রথমে লজ্জা লাগছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মনে হলো—এটা ঠিক যেমন দাঁতে সমস্যা হলে ডেন্টিস্ট দেখাই, মন খারাপ হলে মনোবিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়াও তেমনি স্বাভাবিক।
কি করবেন:
-
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
-
পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রেও ফ্রি কাউন্সেলিং পাওয়া যায়।
-
ওষুধ বা থেরাপি প্রয়োজন হলে লজ্জা না করে নিন।
উপসংহার:
আমাদের সমাজ মায়েদের সুপারহিরো বানাতে চায়—কিন্তু আমরা আগে মানুষ।
আমরা কাঁদি, ক্লান্ত হই, অসহায় বোধ করি—এগুলো অস্বাভাবিক নয়।
আজ আমি অনেকটা ভালো আছি। নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া শিখেছি।
আপনিও পারবেন। শুধু একটু নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের মনের কথাগুলো শুনুন।
মনে রাখবেন—একজন সুস্থ, হাসিখুশি মা মানেই একটা ভালোবাসাময় পরিবার।
তাই নিজের মনের যত্ন নেওয়া আপনার মাতৃত্বেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।



